নজরবন্দি ব্যুরো: চল্লিশে তিরাশি! সালটা ১৯৮৩, তারিখটা ২৫ জুন। কপিল দেবের নেতৃত্বে দুনিয়া কাঁপানো ওয়েস্ট ইন্ডিস দলের বিরুদ্ধে অসাধারণ লড়াই করে প্রথম বারের জন্য বিশ্বকাপ জিতেছিল ভারত। দেখতে দেখতে আজ পূর্ণ হল চল্লিশ বছর। এর মাঝে দু-দু’টো বিশ্বকাপ জিতেছে ভারত। একটি একদিনের ও একটি টি-টোয়েন্টি। দু’ক্ষেত্রেই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। কিন্তু, প্রথম বিশ্বকাপ জেতার আনন্দই ছিল আলাদা।
আরও পড়ুন: লর্ডসে সৌরভের দাদাগিরি! আজকের দিনেই অভিষেক ম্যাচে শতরান করেন মহারাজ
১৯৮৩ সালে অবশ্য বিশ্বকাপের নাম ছিল ‘প্রুডেনশিয়াল কাপ’। আয়োজক দেশ ছিল ইংল্যান্ড এবং ওয়েলস। সেবার অংশ নিয়েছিল আটটি দেশ। তৃতীয় বারের জন্য বিশ্বকাপ খেলতে নেমেছিল ভারত। তার আগে ১৯৭৫ ও ১৯৭৯ সালে অংশ নিলেও গ্রুপ পর্যায় থেকেই ভারতকে বিদায় নিতে হয়েছিল। সেই রকমই তিরাশির বিশ্বকাপেও ভারতকে নিয়ে বিশেষ প্রত্যাশা ছিল না কারুরই। কারণ, তখন গোটা বিশ্বে একচ্ছত্র রাজ ওয়েস্ট ইন্ডিসের। কে ছিল না সেই দলে? ক্লাইভ লয়েড থেকে শুরু করে ভিভ রিচার্ডস, ম্যালকম মার্শাল, মাইকেল হোল্ডিং, প্রত্যেকেই তাবড় খেলোয়াড়। এঁদের বিরুদ্ধে খেলতে নামলে যে কোনো বিপক্ষ দলের থরহরিকম্প অবস্থা হত। অথচ, খাতায় কলমে ভারতের মতো কমজোরি দলই থামিয়ে দিয়েছিল ক্যারিবিয়নদের বিজয় রথ। এই ঘটনায় অবাক হয়েছিলেন অনেকেই।
বিশ্বকাপের শুরু থেকেই হট ফেবারিট ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিস। তারপর আসত ইংল্যান্ডের নাম। সাংবাদিক মহল থেকে তখনকার প্রাক্তন খেলোয়াড় কেউ দুঃস্বপ্নেও ভারতের নাম নিয়ে চর্চা করেনি। তো এরকম পরিস্থিতিতেই শুরু হয় বিশ্বকাপ। ভারত, ওয়েস্ট ইন্ডিস, অস্ট্রেলিয়া এবং জিম্বাবুয়েকে নিয়ে গঠিত হয়েছিল গ্রুপ-বি। অস্ট্রেলিয়াও একেবারে ফেলে দেবার মতো দল ছিল না। বিশ্বকাপ জয়ী সেই ভারতীয় দলে ছিলেন, কপিল দেব (অধিনায়ক), সুনীল গাভাস্কার, মহিন্দর অমরনাথ, শ্রীকান্ত, যশপাল শর্মা, সন্দীপ পাটিল, কীর্তি আজাদ, রজার বিনি, মদল লাল, সৈয়দ কিরমানি, বলবিন্দর সিধু, দিলীপ বেঙ্গসরকর, রবি শাস্ত্রী। আর একটি মানুষ ছিলেন, যার কথা না বললেই নয়, তিনি হলেন পি.আর.মান সিংহ। তিনি ছিলেন ভারতীয় দলের ম্যানেজার।
গ্রুপ পর্যায়ে তখন প্রত্যেকে প্রত্যেকের সঙ্গে ২টি করে ম্যাচ খেলত। সেখানে কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিসকে একবার হারায় ভারত। বাকী একবার হারে। অন্যদিকে, অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধেও ভারত একটিতে জেতে ও একটিতে হারে। মোট কথা, গ্রুপে দু’নম্বর স্থানে শেষ করে ভারত। গ্রুপ পর্যায়েই জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে মরণ বাঁচন ম্যাচে ১৭৫ রানের ঐতিহাসিক ইনিংসটি খেলেন কপিল দেব। যদিও সেই ম্যাচটি লাইভ সম্প্রচারিত হয়নি। বেতারে কান পেতে গোটা ভারত কপিলের মারকুটে ইনিংসের স্বাদ নিয়েছিল। গ্রুপ পর্যায়ের খেলার শেষে একে ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিস, দুইয়ে ভারত। সবাইকে অবাক করে দিয়ে অস্ট্রেলিয়া গ্রুপ পর্যায় থেকেই বিদায় নিয়েছিল।
এরপর, সেমিফাইনালে ভারতের খেলা পড়ে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। খেলাটা হয়েছিল ম্যাঞ্চেস্টারের বিখ্যাত ওল্ড ট্র্যাফোর্ড ময়দানে। সেখানে ইংল্যান্ডকে পরাজিত করে ভারত। সেই ম্যাচে যশপাল শর্মা করেন ৬১ রান এবং সন্দীপ পাটিল মাত্র ৩২ বলে ৫১ রানের গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলেন। কপিল নিজে নিয়েছিলেন ৩ টি উইকেট। সেমিফাইনালে পাকিস্তানকে হারানোর ফলে ফাইনালে আরেকবার ভারতের মুখোমুখি হয় ওয়েস্ট ইন্ডিস।
১৯৮৩ সালের ২৫ জুন। লর্ডসের মাঠে শুরু হয় ফাইনাল ম্যাচ। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ১৮৩ রানে অলআউট হয়ে যায় ভারত। সবাই ভেবে নিয়েছিল এই বিশ্বকাপ জিততে চলেছে ওয়েস্ট ইন্ডিস। ব্যাট করতে নেমেও ভালো শুরু করে ক্যারিবিয়ানরা। ভিভ রিচার্ডস সবে নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে খেলা শুরু করেছেন। এমন সময় কপিলের থেকে জোর করে বল ছিনিয়ে নেন মদন লাল। যিনি সেদিন একেবারেই ফর্মেই ছিলেন না। মদন লালের বলে ছয় মারতে গিয়ে সেই ওভারেই আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে যান রিচার্ডস। সেটাই বোধহয় ছিল তাঁর সর্বকালের সেরা ব্যর্থতা। রিচার্ডস যদিও আউট হতেন না যদি কপিল দেব তাঁর সেই বিখ্যাত ক্যাচটি না ধরতেন। শর্ট মিড উইকেট থেকে প্রায় বাউন্ডারি লাইন পর্যন্ত পিছনের দিকে দৌড়ে ক্যাচটি ধরেন কপিল। আর রিচার্ডস আউট হতেই খড়কুটোর মতো ভেঙে পড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিসের ইনিংস। মাত্র ১৪০ রানে অলআউট হয়ে যায় তাঁরা। ফাইনালে ম্যাচের সেরা হন মহিন্দর অমরনাথ।
শেষমেশ কপিল দেবের হাতে তুলে দেওয়া হয় বিশ্বকাপ। গোটা দেশ তখন আনন্দে আত্মহারা। চোখের জল বাঁধ ভেঙে দেয়। আজ চল্লিশ বছর পূর্তিতেও যে কথা কথা ভাবলে আমাদের রোম খাঁড়া হয়ে যায়। কারণ, তখন পরিস্থিতি একেবারেই ভারতের জন্য অনুকূল ছিল না। শুধুমাত্র অদম্য জেদ, ইচ্ছাশক্তি আর হার না মানা লড়াইয়ের ওপর ভর করেই একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় চরম সাফল্য অর্জন করেছিল ভারত।