অর্ক সানা: সমস্ত জল্পনার অবসান ঘটিয়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন শুভেন্দু অধিকারী। এখন তিনি বিজেপির সবথেকে চর্চিত মুখ বঙ্গে। বিজেপি-তে শুভেন্দুর সঙ্গে আরও একঝাঁক তৃণমূল বিধায়ক, সাংসদ, বাম বিধায়ক, এমনকী সংখ্যালঘু নেতারাও যোগ দেন। মেদিনীপুরের সভা থেকে নিজের সংক্ষিপ্ত ভাষণে ‘ভাইপো হঠাও’ স্লোগানও দেন শুভেন্দু। ডাক দেন ‘তোলাবাজ’ হটানোরও। টেট বা শিক্ষক নিয়োগ নিয়েও দুর্নিতীর কথা বলেন তিনি। চেয়েছেন বামপক্ষের সমর্থকদের সমর্থন। এহেন শুভেন্দু অধিকারী বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন তাঁর চেনা এবং জেতা আসন নন্দীগ্রাম থেকে। হাফ লাখ ভোটে হারাবেন, চ্যালেঞ্জ করেছেন একদা দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে। কিন্তু কোন অঙ্কে?
আরও পড়ুনঃ IPS বনাম IPS এর লড়াই, এগিয়ে বিজেপি। ডেবরায় কোন অঙ্কে খেলছে তৃণমূল?
বিশ্লেষকরা বলছেন এই হিসেব দেখতে গেলে তাকাতে হবে ইতিহাসের দিকে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের চর্চায় থাকা শুভেন্দু অধিকারীকে নিয়ে অনেকেই বলছেন বা বলার চেষ্টা করছেন নন্দীগ্রামের জমিরক্ষা কমিটির আন্দোলন শুভেন্দু অধিকারীকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। কিন্তু ইতিহাস বলছে অন্য কথা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গ দিয়েছিলেন সেই সব কংগ্রেসী ঘরানার রাজনীতিক দের মধ্যে একজন ছিলেন শিশির অধিকারী। স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত থাকা অধিকারী পরিবারের সদস্য শিশির একজন দক্ষ সংগঠক। তিনি টানা ২৫ বছর কাঁথি পুরসভার পুরপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন।
সেই শিশির অধিকারীর পুত্র শুভেন্দু অধিকারীকে প্রথমবার লাইমলাইটে আসার সুযোগ দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নন্দীগ্রাম আন্দোলন গড়ে ওঠা তো দূরের কথা বাংলার বৃহত্তর অংশের মানুষ তখন নন্দীগ্রামের নামই শোনেন নি। শিশির অধিকারীর পুত্র অল্প বয়স্ক শুভেন্দু অধিকারীকে ২০০৪ সালে তমলুক লোকসভা আসনে তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিট দেন মমতা। কিন্তু তৎকালীন সিপিআইএমের ২বারের সাংসদ দর্দোন্ডপ্রতাপ লক্ষন শেঠের কাছে পরাজিত হন শুভেন্দু! তৃতীয়বারের জন্যে সাংসদ হন লক্ষণ। কিন্তু এখানেই সুযোগ পাওয়া শেষ হয়নি শুভেন্দুর। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শিশির অধিকারীর অপর আস্থা রেখে ২ বছরের মাথায় ২০০৬ সালে ফের কাঁথি দক্ষিন বিধানসভা কেন্দ্র থেকে টিকিট দেন শুভেন্দু কে! কাঁথি-তে শিশির অধিকারীর একচ্ছত্র দাপট জয় এনে দেয় শুভেন্দু অধিকারী কে। তখনও নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহনের কোন ঘটনাই ঘটেনি।
এরপর আসে ২০০৭, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে শুরু হয় আন্দোলন। রাজ্যে হাওয়া লাগে পরিবর্তনের। মমতা কে মুখ করে তখন রাজকীয় আন্দোলন শুরু হয় রাজ্যজুড়ে। রাজ্যের মানচিত্রে চিরকালের জন্যে জায়গা দখল করে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় বাংলার বুদ্ধিজীবী মহল থেকে শুরু করে একাধিক রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব পাশে দাঁড়ান এলাকাবাসীর। এমনকি আসেন লালকৃষ্ণ আডবানির মত নেতাও, কিন্তু আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নন্দীগ্রামে শিশির-শুভেন্দু আর সিঙ্গুরে বেচারাম-রবীন্দ্রনাথরা হয়ে ওঠেন মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে পরিবর্তনের কাণ্ডারী! ফের ২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে পিতা-পুত্র দুজনকেই টিকিট দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তমলুক এবং কাঁথি আসন থেকে জয়ী হন দুজনেই। ইউপিএ সরকারের অন্যতম জোটসঙ্গী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শিশির অধিকারী কে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রমন্ত্রীর আসনে বসান গ্রামোন্নয়ন দফতরের।
এরপর ২০১৪ সালেও জয়ী কম্বিনেশন ভাঙেননি তৃণমূল সূপ্রিমো। ফের লোকসভায় যান শুভেন্দু-শিশির। ২০১৬ সালে রাজ্যে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর শুভেন্দু কে মন্ত্রীত্ব দেন মমতা। তমলুক লোকসভা আসন ছেড়ে নন্দীগ্রাম বিধানসভার বিধায়ক হন শুভেন্দু। তখন তিনি প্রায় ৮১ হাজার ভোটে জিতেছিলেন। ওই বছরেই তমলুক লোকসভার উপ-নির্বাচনে শিশির অধিকারীর অন্য পুত্র দিব্যেন্দু কে টিকিট দেন মমতা। তমলুকের সাংসদ নির্বাচিত হন দিব্যেন্দু অধিকারী। সে সময় নন্দীগ্রাম থেকে প্রায় ১ লক্ষ ৪০ হাজার লিড পেয়েছিলেন দিব্যেন্দু অধিকারী। অর্থাৎ শুভেন্দু অধিকারীর থেকে প্রায় ৬০ হাজার বেশি ভোটের লিড পেয়েছিলেন তিনি।
তবে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে নন্দীগ্রাম থেকে তৃণমূলের লিড কমে হয় প্রায় সাড়ে ৬৮ হাজার। আর বিজেপি-র ভোট ২০১৬ সালে যেখানে ছিল ১০ হাজারের কিছু বেশি, তা ২০১৯ সালে বেড়ে হয়েছে ৬২ হাজারের বেশি! এই পরিসংখ্যান বলছে, ভোট কমেছে তৃণমূলের, বেড়েছে বিজেপি-র। কিন্তু কেন এমন হল? শুভেন্দু অধিকারীর গড়ে বিজেপি-র এহেন উত্থান কিভাবে? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, লোকাল তৃণমূল নেতাদের লাগামহীন দূর্নীতির জেরেই নন্দীগ্রামের মানুষ আস্থা হারিয়েছেন তৃণমূলে। আমপানের ক্ষতিপূরণ নিয়ে বিস্তর গরমিলের অভিযোগ উঠেছে নন্দীগ্রামে! শুভেন্দুও নন্দীগ্রামে এসে প্রকারান্তরে তা স্বীকার করেছেন!
শুভেন্দু এখন বিজেপি নেতা। তাই শুভেন্দুর ধারণা তৃণমূলের প্রতি বিতৃষ্ণা থাকলেও বিজেপির বাড়বাড়ন্ত ভোট ব্যাঙ্ক থাকবে তাঁর দিকেই। তৃণমূলের ৬৮ হাজারের মার্জিন পেরিয়ে যেতে গেলে তৃণমূল থেকে ৩৪ হাজার ভোট কমিয়ে তা যোগ করতে হবে গেরুয়া শিবিরে। অঙ্ক কষা চলছে নিপুণ হাতে। শুভেন্দু ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে খবর, শুভেন্দু দা ব্যাক্তি হিসেবে কমপক্ষে ২৫ হাজার ভোট টানবেন তৃণমূল থেকে। সেক্ষেত্রে তৃনমূলের ৬৮ হাজারের মার্জিনকে নামিয়ে আনা যাবে ১৮ হাজারে। এদিকে শুভেন্দু শিবিরে অন্য আর একটি ভরসার নাম বাম ভোট এবং আব্বাস সিদ্দিকি।
শুভেন্দু অধিকারী বিভিন্ন সভায় বাম তথা সিপিএমের ভোট চাইছেন, সিপিএমের প্রশংসা করছেন। বলছেন আগে তৃণমূল কে তাড়িয়ে দিই তারপর আপনারা সুস্থ ভাবে রাজনীতি করবেন। রাজ্যে সেই পরিবেশ ফিরিয়ে দেবে বিজেপি। এদিকে নন্দীগ্রাম আসন দীর্ঘ্য ৫ দশক পরে জোটের জটে হাতছাড়া হয়েছে সিপিআই এর। প্রার্থী দিচ্ছে আইএসএফ অর্থাৎ আব্বাস সিদ্দিকির দল। শুভেন্দু শিবিরের বিশ্বাস অন্তত ৫ হাজার বাম ভোট পড়বে ব্যাক্তি শুভেন্দুর আবেদনে সাড়া দিয়ে এবং নিজেদের প্রার্থী না থাকার ক্ষোভে। অর্থাৎ তৃণমূলের লিড নেমে আসবে ১৮-৫ অর্থাৎ ১৩ হাজারে। অন্য আর এক বড় ভরসার নাম আব্বাস সিদ্ধিকি। শুভেন্দু ভোট ম্যানেজারদের বিশ্বাস তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোট ব্যাঙ্ক থেকে আব্বাস নিজের ক্যারিস্মায় টেনে নেবেন অন্তত ২০ হাজার ভোট! সুতরাং এই ভোট বিজেপিতে যুক্ত না হলেও তৃণমূলের মার্জিন পরিনত হবে ঘাটতি তে! ২০-১৩ অর্থাৎ ৭ হাজার ভোটে পিছিয়ে যাবে তৃণমূল!
অর্থাৎ ৫০ হাজার না হলেও শুভেন্দু অন্তত ৭ হাজার ভোটে জিতবেন বলে বিশ্বাস বিজেপির! কিন্তু অঙ্ক ঘেঁটে দেওয়ার জন্যে যিনি নন্দীগ্রামে তৃণমূলের ভোটপ্রার্থী তাঁর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অসাধ্যসাধন করতে ওস্তাদ মমতা নিজেই লড়তে গিয়েছেন রাজ্যের অন্যতম টাফ কেন্দ্রে। আব্বাস বা বাম ভোট নয় মমতার ভরসা তাঁর উন্নয়ন আর ইমেজ। যে ইমেজে ভর করে সারদা নারদা ইস্যু তুড়ি মেরে উড়িয়ে ২০১৬ সালে দ্বিতীয়বারের জন্যে বাংলার মসনদে বসেছিলেন তিনি। এবার হ্যাট্রিক চান্স…কার্যত খোঁচা খাওয়া বাঘিনীর মত সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মমতা। বাকিটা বোঝা যাবে ২রা মে।