নজরবন্দি ব্যুরোঃ নরেন্দ্র মোদী। তিনি শুধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাই নয়, এই মুহূর্তে বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় রাষ্ট্রনেতাদের একজন। আট থেকে আশি, মোদীকে চেনেন না এমন মানুষের সংখ্যা খুব কমই আছে। কিন্তু, আজকের এই জায়গায় আসাটা কোনও ম্যাজিকের দ্বারা সম্ভব হয়নি। একজন চা-ওয়ালা থেকে ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী—শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও শুধুমাত্র নিজের অদম্য জেদ, সাহস আর নিষ্ঠার মাধ্যমে তাকে বাস্তবে রূপান্তর করেছেন একজন মানুষই। তিনি নরেন্দ্র মোদী। এক কথায়, তিনি একজন কর্মযোগী মানুষ। আজ, ১৭ই সেপ্টেম্বর নরেন্দ্র মোদীর জন্মদিন। ভারতবর্ষের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিন। তাই আরও একবার স্মৃতিচারণা সেই মানুষটার, যিনি ক্রমাগত স্বপ্ন দেখাতে ভালোবাসেন এবং আগামী দিনেও যিনি স্বপ্ন দেখাবেন আপামর ভারতবাসীকে।
১৯৫০ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর মেহসানা জেলার ভাদনগর গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন নরেন্দ্র মোদী। বাবার নাম দামোদর দাস মোদী এবং মা হীরাবেন মোদী। নরেন্দ্র ছিলেন তাঁদের তৃতীয় সন্তান। প্রচন্ড অভাবেই মধ্যেই মোদীর ছোটবেলা কেটেছে। ছয় ছেলেমেয়েকে নিয়ে টানাটানির সংসারে মা হীরাবেনও কখনও আলাদা করে ছেলেকে সময় দিতে পারেননি। ভাদনগর রেলস্টেশনে দামোদর দাসের একটি ছোট্ট চায়ের দোকান ছিল। ছোটবেলায় সেই দোকানেই বাবার সাথে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। কোনও কাজেই লজ্জা ছিল না ছোটবেলা থেকেই। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই তিনি পারতেন। বলা ভালো, তাঁকে করতে হত। আর কোনও উপায় যে ছিল না!
মাত্র ৮ বছর বয়সে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ অর্থাৎ আরএসএসে যোগ দেন মোদী। সেখান থেকেই তৈরি হয় তাঁর ভারতীয় বোধ। ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করেন ভারতবর্ষকে। ভারতের ঐতিহ্য, ভারতের গরিমাকে লালন করতে থাকেন নিজের মননে। হিন্দু ধর্ম সম্পর্কেও সম্যক ধারণা পান সঙ্ঘের সংস্পর্শে। আরএসএসের দিনগুলিতে তিনি পাশে পেয়েছিলেন লক্ষ্মীরাও ইনামদারকে। যিনি খুব সন্তর্পণে নিজেকে চিনতে শেখান মোদীকে। সেই সময়ই আলাপ হয়েছিল আরও দুই প্রবাদপ্রতিম বিজেপি নেতা গজেন্দ্রগাডকর এবং নাথালাল জাঘদার সঙ্গে। তাঁরাই পরবর্তী সময়ে ১৯৮০ সালে গুজরাতে বিজেপির ইউনিট খুলবেন।
দামোদর দাস ও হীরাবেনও আর পাঁচটা সাধারণ ভারতীয় বাবা-মায়ের মতোই ছিলেন। তাঁরাও ভয় পেয়েছিলেন এই ভেবে যে তাঁদের ছেলে সন্ন্যাস নিয়ে নিতে পারে। তাই সংসারে মন বসাতে মাত্র ১৮ বছর বয়সে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেন ছেলের। পাত্রীর নাম যশোবেন। কিন্তু ততদিনে মোদীর মাথায় সমাজসেবার ভূত চেপে বসেছে। কাউকে না জানিয়েই হঠাৎ করে একদিন বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান মোদী। আর আসেন কোথায়? আমাদের খাস কলকাতায়…
১৯৬৮ সালে বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতায় আসেন মোদী। যোগ দেন বেলুড় মঠে। উদ্দেশ্য ছিল, আরও কাছ থেকে হিন্দু ধর্মকে বোঝা। বইয়ে পড়া স্বামী বিবেকানন্দর সেই সৃষ্টিকে একবার চাক্ষুস দেখা, অনুভব করা, সমাজসেবার জন্যই নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া। বেলুড় মঠে এসে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ভারতবর্ষকে বুঝতে গেলে আরও পড়াশোনা করা প্রয়োজন। তাই শুরু করেন করেন তিনি। সেই সময় বেলুড় মঠ ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের একাধিক জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন মোদী। দেখেছেন মানুষের অভাব। কষ্টকে আরও কাছ থেকে অনুভব করেছেন।
View this post on Instagram
কিন্তু, সেই সময় ইন্দিরা গান্ধীর আমলে দেশে নানান রাজনৈতিক জটিলতা চলছিল। তাই আবার গুজরাতে কাকার বাড়িতে ফেরত আসেন তিনি। ৭১’এর মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি অটল বিহারী বাজপেয়ীর জন সঙ্ঘ সত্যাগ্রহে যোগ দেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় কিছুদিন তিহাড় জেলেও বন্দি ছিলেন। এরপর সেই বছরই জেল থেকে মুক্তি পেয়ে সঙ্ঘের প্রচারক হিসাবে কাজ শুরু করেন মোদী। বেলুড় তাঁকে শিখিয়েছিল পড়াশোনা করতেন হবে। তাই কাজের পাশাপাশি স্কুল অফ ওপেন লার্নিং থেকে গ্র্যাজুয়েশন পাশ করেন তিনি। এরপর গুজরাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিসটেন্সে সম্পূর্ণ করেন মাস্টার্স। বিষয় ছিল রাষ্ট্রবিজ্ঞান।
View this post on Instagram
১৯৭৫ সাল। দেশে আবার নেমে আসে সংকট। এমারজেন্সি জারি করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয় আরএসএসকে। বেশ কিছু দিন গা ঢাকা দিয়ে ছিলেন মোদী। এই সময়ই তিনি বুঝতে পারেন, শুধুমাত্র সমাজসেবার মাধ্যমে দেশের উন্নতি করা সম্ভব নয়। তিনি যে পরিবর্তন চাইছেন তার জন্য প্রয়োজন রাজনীতিতে যোগদান। তাই সেই সময় RSS-এর প্রচারকের পাশাপাশি রাজনীতিতে একটু একটু করে পা বাড়াতে শুরু করেন। RSS-এ থেকেই ১৯৮৭ সালের গুজরাত মিউনিসিপ্যাল ইলেকশন জিততে বিজেপিকে সাহায্য করেন তিনি। এরপর বড় নেতাদের নজরে আসতে সময় লাগেনি। ছোটবেলা থেকেই নাটকে অভিনয় করেছেন মোদী। তাই তিনি বরাবরই খুব ভালো বক্তৃতা দিতে পারতেন। আর তাই মোদীকে সে বছরই গুজরাত বিজেপির সম্পাদক করা হয়। ব্যস সেই থেকে যাত্রা শুরু হয় এক রাজনৈতিক ব্যক্তি জীবনের।
১৯৯৫ সালের মোদীকে বিজেপির সর্বভারতীয় সম্পাদক করা হয়। চলে আসেন দিল্লিতে। হরিয়ানা এবং হিমাচল প্রদেশের রাজনীতিতেও অংশ নেন। এই সময় নিজে ভোটে না লড়লেও বহু বিজেপি নেতাকে জেতানোর নেপথ্যে ছিল নরেন্দ্র মোদীর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী করা হয় মোদীকে। ২০০২ সালে রাজকোট আসন থেকে ভোটে জিতে স্বমহিমায় ফের একবার গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে অভিষেক গ্রহণ করেন মোদী।
গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন যেমন সে রাজ্যের জন্য প্রচুর কাজ করেছেন মোদী, আবার সেই সময়ই মোদীকে নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। ২০০২ সালের গুজরাত দাঙ্গা আজও তাঁর জীবনের একটি কালো অধ্যায়। সব বড় মানুষদের জীবনেই বোধহয় এক একটা এরকম সময় আসে! যদিও তার জন্য একটুও জনপ্রিয়তা কমেনি মোদীর। ২০০৭ এবং ২০১২ সালেও ভোটে জিতে তিনিই গুজরাতের দায়িত্বে থাকেন। এই সময় তিনি গুজরাতে এত এত কাজ করেছিলেন যে আসন্ন ২০১৪ লোকসভায় বিজেপির তরফে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী করা হয় নরেন্দ্র মোদীকে। আর প্রথম বারেই বাজিমাত!
View this post on Instagram
ভদোদরা থেকে বিপুল ভোটে জিতে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে অভিষেক নেন নরেন্দ্র মোদী। আর শুধু নিজের আসনেই নয়, সারাদেশে এমন একটা হাওয়া তিনি তুলেছিলেন তাঁর ক্ষুরধার বক্তৃতার মাধ্যমে যে দীর্ঘদিনের কংগ্রেস শাসন ভূলন্ঠিত হয়ে যায় তাঁর সামনে। দেশে ক্ষমতায় আসে বিজেপি। এরপর ২০১৯ লোকসভাতেও বারাণসী কেন্দ্র থেকে জিতে যান মোদী। সেবার বিজেপির মূল স্লোগানই ছিল ‘আবকি বার মোদী সরকার’।
প্রধানমন্ত্রী হিসাবে কাজ শুরু করার পর জনপ্রিয়তা ক্রমেই আরও বাড়তে থাকে মোদির। দেশ থেকে বিদেশ—সব জায়গাতেই নিজের স্বতন্ত্র ভঙ্গিমাতে মানুষের মন জয় করে নিতে থাকেন তিনি। তাই অনেকেই বলে থাকেন, ‘মোদীকে তুমি পছন্দ করতে পার, অপছন্দ করতে পারো কিন্তু উপেক্ষা—নৈব নৈব চ! তুমি এই মানুষটাকে উপেক্ষা করতে পারবে না। এমনই তাঁর ব্যক্তিত্ব, এমনই তাঁর স্বভাব! সব সময় সিরিয়াস মেজাজে থাকতে তিনি পছন্দ করেন না, হালকা চালে অনেক বড় কথাকে সাজিয়ে উপস্থাপন করাই তাঁর শিল্প!
ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনঃ ৭৩ বছরে যা যা করেছেন নরেন্দ্র মোদী!
আজ ৭৩ বছর পূর্ণ করলেন মোদী। অর্থাৎ বয়স হচ্ছে। কিন্তু সেটা তাঁকে দেখে বোঝার উপায় নেই। সব সময় ফিট থাকতে পছন্দ করেন তিনি। এখনও নিয়মিত চলে যোগাভ্যাস। নরেন্দ্র মোদীর জন্মদিনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী নানান কর্মসূচির আয়োজন করেছে বিজেপি। আমরা, ‘নজরবন্দি’-এর পক্ষ থেকেও প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর জন্মদিনে জানাই অনেক অনেক শুভেচ্ছা। আগামী দিনেও নরেন্দ্র মোদী, আপনি ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।