কিংকর অধিকারীঃ হিটলারের প্রচার সচিব গোয়েবলসের থিওরি ছিল, মিথ্যাকে বারবার জোরের সাথে বলো, দেখবে একদিন সেই মিথ্যেটাই বহু মানুষের কাছে সত্য হয়ে গিয়েছে। তাই সত্যটাকে গভীরভাবে উপলব্ধি না করতে পারলে ধোঁয়াশা থেকে যায়। আর সেই ধোঁয়াশা থেকেই সত্য মিথ্যা সব গুলিয়ে যায়। আজকে যে মানুষটি পিপিপি মডেল বা বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে বলছে, কয়েকদিন পরে তাকেই হয়তো বলতে দেখব, ‘এছাড়া কোনো উপায় নেই, এটাই ভালো, এটাই বাস্তব’।
আরও পড়ুনঃ ১০০ বছর বিদ্যুৎ সংকট হবেনা, বাংলায় লক্ষ লক্ষ চাকরি ঘোষণা মমতার
যাঁরা এর বিরোধিতা করছেন বা সমর্থন করছেন তাঁদের উপলব্ধির স্তর কতটা গভীরে? সমাজের মধ্যে ভীষণ রকমের অসাম্যের ফলে বেকার অথবা অল্প বেতনে কাজ করা ব্যক্তিদের একাংশ তাদের আকাঙ্ক্ষা অপূরীত থাকার কারণে তারা চাইছে স্কুল গুলো সব বেসরকারি হয়ে যাক। মাস্টার গুলোর খুব বেতন বেড়ে গিয়েছে।
কেউ বলছেন, বেসরকারি হয়ে গেলে পরিষেবা ভালো পাওয়া যাবে। আবার কারো বক্তব্য পিপিপি মানে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ অর্থাৎ পুরোপুরি ব্যক্তি মালিকের হাতে নয়, সরকার বাহাদুর তো তার সঙ্গে থাকছে। ফলে অসুবিধা কোথায়?
রাজ্যে বিদ্যালয় শিক্ষায় পিপিপি মডেল চালু করার গোপন পরিকল্পনা হয়তো ইচ্ছে করেই তারা ফাঁস করেছে জনগণের মধ্যে তার প্রতিক্রিয়া কি হয় তা মেপে নেওয়ার জন্য। সাথে সাথে মানুষের কাছে তাকে সইয়ে নেওয়া। আসলে এই পরিকল্পনা কার্যকরী করার জন্য প্রায় সমস্ত সরকার দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। তাহলে কীভাবে তারা এটিকে বাস্তবায়িত করবে?
একটা ঘটনা বলি, একসময় সরকার ঠিক করেছিল কলকাতার বিভিন্ন রাস্তা থেকে সরকারি ট্রাম তুলে দেবে। এই পরিকল্পনায় জনগণ খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছিল। মানুষের বক্তব্য ছিল, ট্রাম এমন একটি যানবাহন যা পরিবেশ বান্ধব এবং যাতায়াতের ক্ষেত্রে খুবই আরামদায়ক, অনেক মানুষ একসাথে একটু খোলামেলা ভাবে যাতায়াত করতে পারে, ভাড়া কম, অন্যান্য যানবাহনের মত দূষণ সৃষ্টি করে না ইত্যাদি।
সরকার চেয়েছিল বাস মালিকদের স্বার্থে নিজেদের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে। মানুষের তাৎক্ষণিক ক্ষোভের ফলে সরকার তাদের পরিকল্পনাটাকে কিছু দিন পিছিয়ে দিল। তারা ঠিক করল ট্রাম লাইনগুলো নিয়মিত চেকিং বা মেরামত করবে না। এরফলে ট্রাম যখন-তখন বেলাইন হতে থাকলো। ব্যস্ততম শহরের মূল রাস্তায় আড়াআড়িভাবে লাইনচ্যুত হওয়ার ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতো। দ্রুত সারানোর কোন উদ্যোগ নেওয়া হত না। এরকম প্রতিনিয়ত ঘটার ফলে ব্যাপক যানজটে মানুষ অতিষ্ঠ হতে থাকলো। দিনের পর দিন ঘটতে থাকা অসহনীয় এই পরিস্থিতির চাপে সেই জনগণ নিজের থেকেই বলাবলি শুরু করলো, ট্রামগুলো তুলে দেওয়াই দরকার।
দিনের পর দিন রাস্তায় যানজট বাড়তে থাকায় এইভাবে জনমত ঘুরে যাওয়ার ফলে সরকার তাদের পূর্ব পরিকল্পনা দ্রুত হাসিল করে নিল। বহু রাস্তা থেকে ট্রাম তুলে দেওয়া সহজ হয়ে গেল।
দীর্ঘদিন শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী নিয়োগ না করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্রমশ মানুষের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করে তোলা হচ্ছে। নেই নৈশ প্রহরী, নেই ঝাড়ুদার। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতেও নেই পর্যাপ্ত শিক্ষক, নেই পরিকাঠামো, নেই গ্রুপ ডি, ক্লার্ক-এর পদ। অর্থের বিনিময়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গুলিতে যা রয়েছে, সরকারি স্কুলের পরিকাঠামোতে তা নেই। শিক্ষা বহির্ভূত অসংখ্য কাজে জেরবার করে রাখা হয়েছে বিদ্যালয়গুলিকে। ব্যর্থতার সরকারি দায় চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে অন্যদের ঘাড়ে।
শিক্ষায় পিপিপি পরিকল্পনা, কোথায় লাভ? ক্ষতি কতটা? বিশ্লেষণ কিংকর অধিকারীর।

শিক্ষায় বেসরকারি অথবা পিপিপি মডেল চালু হলে কার ক্ষেত্রে কী কী সুবিধা হবে?
১) শিক্ষায় সরকারের যে বিপুল ব্যয় ভার তার দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া সম্ভব হবে। ধীরে ধীরে বেসরকারি মালিকদের ব্যবসার ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ছেড়ে দিলে জনগণ সেই ব্যয় ভার বহন করবে। সরকারের বিপুল খরচ কমে যাবে।
২) পিপিপি মডেলের মাধ্যমে প্রথমে সরকারি শেয়ার বেশী থাকার ফলে বিল্ডিং এবং জায়গা জমি সবই কোন খরচ না করেই তার অংশীদার হতে পারবে বেসরকারি মালিক। সরকারি অর্থে সাজানো সংসারে কিছুটা বিনিয়োগ করেই ক্রমশ করায়ত্ত করে ফেলবে তারা ধীরে ধীরে শেয়ার বাড়ানোর নামে। তারপর ৫০ শতাংশের বেশি শেয়ার হলেই সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলি প্রায় পুরোপুরি তাদের মুনাফা লোটার মৃগয়া ক্ষেত্রে পরিণত হবে। সরকারি অর্থাৎ জনগণের অর্থে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের কব্জায় এলে তাদের সুবিধাই হবে। কারণ তারা নিশ্চয়ই দানছত্র খোলার জন্য এই প্রকল্পে যুক্ত হবে না।
৩) ক্ষমতাশালী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলি বড় বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে ভোটে ক্ষমতায় জেতে। তাই তাদের স্বার্থ দেখতে তারা বদ্ধপরিকর। ফলে সরকারগুলি এভাবেই তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে। এরা একে অপরের পরিপূরক। দুই পক্ষেরই সুবিধে হয় এতে।
৪) যাদের প্রচুর অর্থ রয়েছে তারা বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে সেইসব বেসরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষার সুযোগ পাবে।
৫) সমাজে আর্থিক বৈষম্য তীব্র হওয়ার ফলে একশ্রেণীর মানুষ হিতাহিত বিবেচনা না করেই অন্যকে জব্দ করা যাবে এই মানসিকতায় এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে মনে মনে তৃপ্তি পাবে। যদিও সেই আনন্দ পরবর্তীতে বুমেরাং হয়ে নিরানন্দের কারণ হবে।
শিক্ষায় বেসরকারি অথবা পিপিপি মডেল চালু হলে কার ক্ষেত্রে কী কী অসুবিধা হবে
১) শিক্ষার অধিকার যে সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার এবং তা যে রাষ্ট্রের দায়িত্ব — তা পুরোপুরি অস্বীকার করা হবে। সরকারি বিদ্যালয়গুলিতে বিদ্যা গ্রহণের যে সুযোগটুকু রয়েছে তা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হবে। আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারের সন্তানরা মেধা থাকলেও সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
২) ভারতবর্ষে উনবিংশ শতাব্দীতে নবজাগরণের ধারাবাহিকতায় বিদ্যাসাগরের মতো মহান ব্যক্তিদের চিন্তার প্রভাবে প্রায় প্রতিটি বিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল তৎকালীন মানুষের জমি দান, শ্রম, অর্থ সবকিছুর বিনিময়ে। প্রথম অবস্থায় সরকারি কোন সাহায্যই ছিল না। পরবর্তী ক্ষেত্রে মানুষের প্রচেষ্টায় গভর্নমেন্ট এডেড স্কুলে রূপান্তরিত হয় সেগুলি। শিক্ষক নিয়োগ, পরিকাঠামোর উন্নতি ইত্যাদিতে সরকারি সাহায্য আসে কিন্তু পরিচালন কমিটির অধীনে বিদ্যালয়গুলির সম্পত্তি তাদের নিজেদের হাতেই থাকে। শিক্ষা জগতের মনীষীদের বক্তব্যই ছিল শিক্ষাক্ষেত্রে সরকার কেবল অর্থ দেবে বাকি সবকিছুই দেখবে শিক্ষাবিদগণ। সেখানে সরকারি কোনো খবরদারি চলবে না। এরাজ্যে ২০১১ সালে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর সরকারি হুমকি এবং ভয় দেখিয়ে সেইসব বিদ্যালয়গুলোকে গভর্নমেন্ট স্পন্সর্ড-এ রূপান্তরিত করা হয় রাতারাতি। সচেতন সংগঠনগুলি এর বিরোধিতা করলেও প্রতিরোধ করতে পারেনি। অনেকে ভেবেছিল এর ফলে সব দিক দিয়ে উন্নতি হবে কিন্তু সেই চিন্তা যে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত তা প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে। ফলে জনগণের দান করা বিদ্যালয়ের সমস্ত সম্পত্তি এক ধাক্কায় সরকারের হাতে চলে যায়। যার ফলে আজ পিপিপি মডেল চালু করা অত্যন্ত সহজ হয়ে যাবে। বিদ্যালয় গুলির স্বাধীকার একটার পর একটা হরণ করা সহজ হবে।
৩) শিক্ষায় পিপিপি মডেল চালু হলে ধীরে ধীরে বেসরকারি মালিকের আধিপত্য কায়েম হবে এবং তারা সরাসরি শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে বিদ্যালয়ের টিউশান ফি, ভর্তি ফি নিজের মতো করে নির্ধারণ করার সুযোগ পাবে। এর ফলে বিপুল পরিমাণ মুনাফা লোটার সুযোগ পাবে তারা। প্রায় ১৫ শতাংশ পরিবার আর্থিক সচ্ছলতার কারণে বেসরকারি শিক্ষা গ্রহণে বাধ্য হলেও শিক্ষার সমান সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে দরিদ্র এবং বিশেষ করে গ্রামের সাধারণ বাড়ির বিপুল সংখ্যক ছেলেমেয়ে। তারা সবদিক থেকে পিছিয়ে পড়তে বাধ্য।
৪) বিপুল সংখ্যক উচ্চ শিক্ষিত বেকারদের বেকারত্বের যন্ত্রণার সুযোগ নিয়ে বেসরকারি বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী নিয়োগ করা হবে নামমাত্র কিছু অর্থের বিনিময়ে এবং মধ্যযুগীয় পদ্ধতিতে খাটিয়ে নেওয়া হবে তাদের। স্থায়ী চাকরি যে সম্ভাবনা ছিল তা চিরজীবনের মতো বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
যারা আমরা জেনে বা না জেনে বেসরকারিকরণের পক্ষে মতামত রাখতাম তারা নিশ্চয়ই গত দু’বছরে কোভিড পরিস্থিতিতে বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কী হাল তা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পেরেছি। কী বিপুল অর্থ বেসরকারি হাসপাতাল এবং নার্সিংহোমগুলি মৃত্যুপথযাত্রী পরিবারদের কাছ থেকে কত নিষ্ঠুর ভাবে লুটে নিয়েছে! একইভাবে শিক্ষার ক্ষেত্রে পিপিপি মডেলের মাধ্যমে বেসরকারিকরণকে আমরা মেনে নিতে পারি কি?
রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যে বিষয়গুলি সরকারি দায়িত্বের মধ্যে পড়ে তার মধ্যে অন্যতম হলো শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য। সকলেই যেন সুলভে তা পেতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্যই তো সরকার। কেন্দ্র অথবা রাজ্য সরকারগুলি তার সেই দায়িত্ব থেকে যদি হাত গুটিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করে তাহলে কোনভাবেই তা মেনে নেওয়া যায় না। আজ যদি তা মেনে নিই তাহলে আগামী প্রজন্মের চরম দূর্দশার জন্য আমরা দায়ী থাকব।
যদিও রাজ্যের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, তিনি এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না। এমনকি পিপিপি মডেলের যে খসড়া প্রকাশিত হয়েছে সেটি সম্পূর্ণ ফেক বলে বলা হয়েছে। তা যদি সত্যি হয় তাহলে এই ড্রাফট কীভাবে তৈরি হয়েছে, কীভাবে প্রিন্সিপাল সেক্রেটারির সই জাল করা হয়েছে তার তদন্ত হোক। এই বিতর্কের অবসান ঘটানোর জন্য রাজ্য সরকার অথবা শিক্ষা দপ্তরের পক্ষ থেকে জনগণকে পরিষ্কারভাবে এই বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হোক যে, ভবিষ্যতে এ ধরনের কোন পরিকল্পনা তাঁদের নেই। তা যদি না করেন তাহলে এই বিতর্ক এবং তাকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ, বিদ্রোহ চলতেই থাকবে।